শীর্ষ ছবি: ১৯১৫ সালের আশেপাশে অটোক্রোমে তোলা ওয়াটার লিলির ফটোগ্রাফ। (সুত্র: Water lilly. Autochrome, circa 1915. ©George Eastman House / Joseph Anderson / The Image
প্রথম ক্লিক !!: ইমেজ সেন্সর আর বেয়ার ফিল্টারের আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ডিজিট্যাল ফটোগ্রাফির জন্ম হয় ৮০’র দশকে। ডিজিট্যাল ক্যামেরার উপস্থিতি এখন সর্বত্র। কিন্তু ছবি তোলার এই সহজ উপায়টি আসার আগে, কোন একটি মুহুর্তকে ফটোগ্রাফে বন্দী করে রাখার জন্য আমাদের প্রচেষ্টার ইতিহাস কিন্তু প্রায় দেডশ বছরেরও বেশী। সেই ইতিহাসের কিছু মাইলস্টোন নিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি নিচে। শেষ মাইলস্টোনটি জর্জ ইষ্টম্যানের রোলড ফিল্ম আর পোর্টেবল কোডাক ক্যামেরা। ১৮৫৪ সালে ১২ জুলাই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক এর ওয়াটারভিলে জন্ম গ্রহন করেন। জীবনের সব প্রতিকুলতাকে জয় করে তিনি একজন আবিষ্কারক ও সফল ব্যবসায়ী হতে পেরেছিলেন। আমি আমার এই সামান্য লেখাটি ফটোগ্রাফির সেই অগ্রদুত,আবিষ্কারক এবং ফিলানথ্রপিষ্ট জর্জ ইষ্টম্যান এর স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ করছি :
ভূমিকা:
১৮৬১ সালে রয়্যাল ইনস্টিটিউশনের একটি লেকচারের সময় স্কটিশ পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল তিনটি প্রধান রঙ্গের সন্নিবেশ আর বিভাজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রঙ্গীন ছবি তোলার জন্য তার তত্ত্বটি আবিষ্কারের ঘোষনা দেন। সেই সময় থেকেই যে মুলনীতি পরবর্তীকালে প্রায় সব ধরনের ফটোকেমিক্যাল আর ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে রঙ্গীন ছবি তোলার মুল ভিত্তিতে পরিনত হয়। এই আবিষ্কারের ১৫০ বছর পুর্তিতে গত ২৭ শে মে নিউ সায়েন্টিষ্ট পত্রিকা তাদের ওয়েবসাইটে যে সব অসাধারন বিজ্ঞানী আর গবেষকদের প্রচেষ্টার কারনে রঙ্গিন ফটোগ্রাফী সম্ভব হয়েছে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি স্লাইড শো প্রকাশ করে। আমার লেখাটি সেই স্লাইডগুলো বেশ খানিকটা পরিবর্ধন আরো তথ্য সন্নিবিষ্ট করে।
আসুন রঙ্গীন ফটোগ্রাফের সেই ইতিহাসের কিছু মাইল ফলক ছুয়ে আসি।
অবশেষে ছবিকে স্থায়ী রুপ দিতে পারা:
জোসেফ নিসেফোরে নিয়েপসে (১৭৬৫ সালের প্রতিকৃতি)(সুত্র: Wikimedia)
ফটোগ্রাফির অন্যতম আবিষ্কারক এবং অগ্রদুত ফরাসী আবিষ্কারক জোসেফ নিসেফোর নিয়েপসে (Joseph Nicéphore Niépce) (মার্চ ৭, ১৭৬৫ -জুলাই ৫, ১৮৩৩) ১৮২২ সালে সর্বপ্রথম স্থায়ী ফটোগ্রাফটি তৈরী করেন। প্রথমে তিনি একটি কাচের প্লেটের উপর বিটুমেন একটি প্রলেপ দেন। তারপর সেটাকে রোদে শুকিয়ে শক্ত করেন। তারপর এই শক্ত বিটুমেনের প্রলেপ লাগানো কাচের পাতটি ক্যামেরা অবস্ক্যুরার মধ্যে ঢুকিয়ে ৮ ঘন্টা এটাকে এক্সপোজার দেন। এর পর ল্যাভেন্ডার তেল ব্যবহার করে নরম আর এক্সপোজড হয়নি এমন বিটুমেনগুলো মুছে ফেলেন, আর কাচের উপর থেকে যায় একটি দীর্ঘস্থায়ী ইমেজের ফটোগ্রাফ। নীচের ছবিটি এমনই একটি প্রক্রিয়ায় তিনি সৃষ্টি করেছিলেন ১৮২৬ সালে। তার তোলা এই ফটোগ্রাফটি এখনো টিকে আছে।
নিসেফোর নিয়েপসেই এখনো টিকে আছে এমন একটি প্রাকৃতিক দৃশ্যেটির এই সর্বপ্রথম ফটোগ্রাফটি তোলেন তার ক্যামেরা অবস্ক্যুরা দিয়ে, এটি তার ল্যাবরেটরির জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য।১৮২৬ সালের এই ফটোগ্রাফটির নাম The View from the Window at Le Gras (সুত্র : Wikimedia)
নিসেফোর নিয়েপসে’র সম্ভবত দ্বিতীয় ফটোগ্রাফ(১৮২৯)।
পাইওনিয়ার নাকি প্রতারক:
লেভি এল হিল (Levy L. Hill)’ এর একটি ডগেরোটাইপ।১৮৫১ সালে Daguerreian Journal এ পাঠানো একটি চিঠিতে দাবী করেন,তিনি রঙ্গীন ফটোগ্রাফির কৌশল আবিষ্কার করেছেন।(http://media.smithsonianmag.com/ images/ ATM-daguerreotype-Levi-Hill.jpg: National Museum of American History, SI)
ঠিক কখন আসলে কালার ফটোগ্রাফের প্রথম আবির্ভাব হয়েছে তা খানিকটা রহস্যময়। ১৮৫০/১৮৫১ সালে নিউ ইয়র্কের ক্যাটস্কিল মাউন্টেন এর ওয়েস্ট কিল কাউন্টির একজন ব্যাপিষ্ট পাদ্রী,লেভী হিল (জন্ম ১৮১৬), প্রথম দাবী করেন,তিনি রঙ্গীন ছবি তোলার একটি কৌশল আবিষ্কার করেছেন। তার এই প্রক্রিয়ার নাম তিনি দিয়েছিলেন হেলিওক্রোমী (Heliochromy), আর এই পদ্ধতিতে তোলা ফটোগ্রাফীর প্লেটগুলো পরিচিত ছিল হিলোটাইপ (Hillotype) নামে।কিন্তু কিভাবে তিনি কাজটা করতেন তা তিনি পেটেন্ট না হওয়া পর্যন্ত কাউকে জানাতে রাজী ছিলেন না। তার পেটেন্টের আবেদন মন্জুরও হয়নি। ১৮৫৬ সালে তিনি যখন সবাইকে তার কৌশলটি দেখান ততদিনে তিনি তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন বিজ্ঞানী সমাজে। কারন তার সমকালীন অনেকেই মনে করেছিলেন আসলে রংটি তিনি হাত দিয়ে পরে যোগ করেছেন। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব অ্যামেরিকান হিস্ট্রি’র গবেষকরা রাসায়নিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখিয়েছেন যদিও হিলোটাইপ প্লেটগুলোতে রঙের উজ্জ্বলতা বাড়াতে বাড়তি রঙ ব্যবহার করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু ফটোগ্রাফের রঙের সেটাই পুরো কারন না বরং তারা দেখেছেন যে এই প্লেটগুলোর লাল আর নীল রঙ গুলো আসলেই ( যদিও খুব স্থুলভাবে) ফটোগ্রাফের অংশ। প্রকৃতির রঙকে স্থুলভাবে যা ধারন করতে পেরেছে, হয়েছে ঠিকই কিন্তু লেভী হিল নিজহাতে ছবির রঙকে আরো আকর্ষনীয় করতে কিছু বাড়তি রঙ যোগ করেছেন যেটি মুল ফটোগ্রাফের অংশ না।
লেভি হিলে’র একটি হিলোটাইপ (১৮৫০); প্রথম রঙ্গীন ফটোগ্রাফ তৈরী করতে লেভী হিলের প্রচেষ্টা। (Image: Levi Hill/Information Technology and Society Division, National Museum of American History)
লেভী হিলের আরেকটি হিলোটাইপ (১৮৫১-১৮৫৬, কিছুটা প্রাকৃতিক রঙকে তিনি আসলে ধরতে পেরেছিলেন; (সুত্র: Wikimedia)
অ্যাডিটিভ কালার থিওরী (রঙের সাথে রঙ মিশিয়ে যৌগিক রঙ):
কালার হুইল হাতে তরুন জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (১৩ জুন, ১৮৩১ -৫ নভেম্বর ১৮৭৯); সুত্র: Wikimedia)
১৮৬১ সালেই রঙ্গীন ফটোগ্রাফের তাত্ত্বিক ভিত্তির গোড়াপত্তন করেন স্কটিশ পদার্থবিদ ও গনিতজ্ঞ, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজমের ক্ল্যাসিক তত্ত্বের প্রবক্তা জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। রয়্যাল সোসাইটিতে দেয়া লেকচারে তিনি দেখান যে প্রকৃতির যে কোন রংই লাল, সবুজ আর নীল বিভিন্ন মাত্রায় মিশিয়ে তৈরী করা সম্ভব। তিনি তার এই আইডিয়াটা প্রমান করেন টারটান রিবনের তিনটি সাদা কালো ট্রান্সপারেন্সি যথাক্রমে লাল,সবুজ আর নীল ফিল্টারের পেছনে রেখে, তিনটি আলাদা আলাদা প্রোজেক্টরের মাধ্যমে তাদেরকে পর্দায় একটার উপর একটা প্রতিচ্ছবি সুপারইম্পোজ করে। ফলাফল তিন রঙ্গা একটি ছবি। নীচের ছবিটি এর কিছুদিন পর তেমনভাবে তোলা একটি ফটোগ্রাফ। ম্যাক্সওয়েলের তিন রঙ মিশিয়ে রঙ্গীন ছবি তৈরী করার এই রঙ সংমিশ্রন ( Additive color synthesis) কৌশলটা পরবর্তী কালে রঙ্গীন ফটোগ্রাফ আর ছাপার ক্ষেত্রে মুল কৌশল হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে আজ পর্যন্ত। মজার ব্যাপারটা হলো ম্যাক্সওয়েল কিন্ত কালার ফটোগ্রাফির তত্ত্বর জন্য তার বক্তৃতাটা দেনটি, তিনি আসলে দেখাতে চাচ্ছিলেন মানুষের রঙ সংবেদন করার মুল ভিত্তিটা হলো লাল,সবুজ আর নীল (RGB), এরাই আমাদের সব রঙ বোঝার প্রাইমারী তিনটি রঙ, তখনকার প্রচলিত ধারনার রঙ লাল, হলুদ, নীল না। এখনও সব সাধারন ধরনের রঙ্গীন ভিডিওর এটাকেই মুল কৌশল হিসাবে ব্যবহার করে ।
পৃথিবীর প্রথম স্থায়ী রঙ্গীন ফটোগ্রাফ(১৮৬১); এডিরবরা’র ১৪ ইন্ডিয়া স্ট্রীটে যে বাসায় মাক্সওয়েল জন্ম গ্রহন করেছিলেন সেখানে এই ফটোগ্রাফটির মুল তিনটি প্লেট সংরক্ষিত আছে।(Image: James Clerk Maxwell) (সুত্র: Wikimedia)
১৮৬১ সালে জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল তার তত্ত্ব অনুসারী স্কটিশ টারটান রিবনের ছবি তোলেন। মুল ছবিটি আসলে তোলে টমাস সাটোন, যিনি সিংগেল লেন্স রিফ্লেক্স ক্যামেরার আবিষ্কারক। ম্যাক্সওয়েলের পরীক্ষানুযায়ী তিনি তিনটি ফিল্টার ব্যবহার করে (লাল, নীল, সবুজ) তিনবার এক্সপোজার নেন।তিনি আসলে হলুদ ফিল্টারও ব্যবহার করেছিলেন , যেটি ম্যাক্সওয়েল তার লেকচারে প্রদর্শন করেননি। যদি এটি একেবারে নিখুত না কারন সাটনের প্লেট লাল রং এ কোন সংবেদনশীলতা ছিল না, সবুজে ছিল আংশিক সংবেদনশীলতা। ম্যাক্সওয়েল লেখেন: “if the red and green images had been as fully photographed as the blue,” it “would have been a truly-coloured image of the riband. By finding photographic materials more sensitive to the less refrangible rays, the representation of the colours of objects might be greatly improved.” ।
সাবস্ট্রাকটিভ কালার:
১৯১২ সালে তোলা লুই আর্থার ডুকো দ্যু আউরঁ (৮ ডিসেম্বর ১৮৩৭ -৩১ আগষ্ট ১৯২০)এর একটি ফটোগ্রাফ (সুত্র:http://www.autochromes.culture.fr/index.php?id=403&L=0)
ফরাসী লুই আর্থার ডুকো দ্যু আউরঁ (Louis Ducos du Hauron) ছিলেন রঙ্গীন ফটোগ্রাফির আরো একজন পাইওনিয়ার। ১৮৬২ সালে তিনি তার এক নতুন ধরনের কৌশলের কথা প্রথম লেখেন। ম্যাক্সওয়েলের তিন রঙের মুললীতির বা অ্যাডিটিভ কালার সিনথেসিস এর সাথে তিনি সংযোগ করেন তার উদ্ভাবিত সাবস্ট্রাকটিভ অ্যাসেম্বলী মেথড (Substractive assembly method) প্রক্রিয়াটি। ১৮৬৯ সালে তিনি তার উদ্ভাবনের প্যাটেন্ট পান এবং Les Couleurs en Photographie পত্রিকায় মুলনীতিটা প্রকাশ করেন। সাবস্ট্রাকটিভ অ্যাসেম্বলী মেথড এ করা তার বিখ্যাত যে কাজটি এখনও টিকে আছে এবং বহুবার পুণমুদ্রিত হয়েছে তা হলো (নীচে)View of Agen, ১৮৭৭ সালে দক্ষিন ফ্রান্সের একটি প্রাকৃতিক দৃশ্যের রঙ্গীন ফটোগ্রাফ।
View of Agen, ১৮৭৭, ফটোগ্রাফটিতে দুরে St.Caprais গীর্জা দেখা যাচ্ছে।
১৮৭৪,ডুকো দ্যু আউরঁ‘র বাসা (Agen)http://www.canalacademie.com/IMG/ ducos_du_hauron_bis.jpg
ট্রাইক্রোম পাখি, ১৮৬৯,ডুকো দ্যু আউরঁ http://autochromes.nettementmieux.com/ uploads/pics/trichromie_oiseaux.jpg
তিনি যে পদ্ধতিটি (ট্রাইক্রোম)ব্যবহার করেছিলেন তা হলো colour subtractive system , প্রাইমারী রঙ গুলো সংমিশ্রন না করে অন্য আরেকটা উপায় হলো সাদা রঙ থেকে একটা একটা করে রঙ বাদ দেয়া। মাক্সওয়েলের মতই প্রথমে ৩টি পৃথক ছবি তোলা হয় তিনটি আলাদা আলাদা ফিল্টার ব্যবহার করে। এই ৩টি ছবির নেগেটিভ ইমেজ আলোকসংবেদী জেলাটিন স্তরের উপর পজিটিভ তৈরী করা হয়। তার পর তাকে সংশ্লিষ্ট রঙ অনুযায়ী রঙ ব্যবহার করে ডেভেলপ করা হতো। জেলাটিন এর উপর ক্রোমেট এর দ্রবনের প্রলেপ দিয়ে একে আলোতে এক্সপোজ করলে জেলাটিন পানিতে অদ্রাব্য হয়ে যায় এটা আগেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। যে অংশগুলো পানিতে মিশে যায়, সেগুরো পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলে স্বচ্ছ ছবি রয়ে যায় ম্যাজেন্টা,সায়ান বা হলুদ রঙে রাঙানো। এই মৌলিক কৌশল এখনও ব্যবহৃত হজ্ছে ফটোগ্রাফিতে। এছাড়া তিনি ১৮৯১ সালে প্রথম কাগজে অ্যানাগ্লিফিক প্রক্রিয়ায় স্টেরিওস্কোপিক (Anaglyph stereiscopic) ফটোগ্রাফ প্রিন্ট কৌশল বা লাল আর নীল কাচের দেখার উপযোগী ৩- ডি প্রিন্ট কৌশল উদ্ভাবন করেন।
বর্ণালীর সব রঙের খোজে:
হেরমান ভিলহেম ভোগেল (মার্চ ২৬,১৮৩৪ -ডিসেম্বর ১৮৯৮); সুত্র: Wikimedia
হেরমান ভিলহেম ভোগেল, জার্মানে এই ফটোকেমিষ্ট এবং ফটোগ্রাফার, ফটোগ্রাফির একটি গুরুত্বপুর্ন আবিষ্কারের আবিষ্কারক। রঙ্গীন ফটোগ্রাফির সেই আদি যুগে ছবিতে রঙ ভালো আসতো না। আলোক-সংবেদী ইমালশানে বা দ্রবনে তখন ব্যবহৃত সিলভার হ্যালাইড অন্য রঙের তুলনায় নীল রঙের (নীল, বেগুনী, অতিবেগুনী) প্রতি বেশী সংবেদনশীল ছিল। ১৮৭৩ সালে ভোগেল এই সমস্যার সমাধান করেন যখন তিনি লাল আর সবুজ রঙের প্রতি সিলভার হ্যালাইডের সংবেদনশীলতা বাড়ানোর জন্য একটি প্রক্রিয়া (বেশ কিছু রাসায়নিক ডাই) খুজে পান। ডাই বা রঙ সেন্সিটাইজেশনের প্রক্রিয়াটি ভোগেলের অন্যতম অবদান। ইংল্যান্ড থেকে আসা ফ্যাক্টরীতে প্রস্তুত কিছু কোলোডিওয়ন ব্রোমাইিড এর ড্রাই প্লেট নিয়ে পরীক্ষা করার সময় ভোগেল লক্ষ্য করেন যে,নীলের চেয়ে তারা বেশী সংবেদী সবুজ রঙের প্রতি। কারন খুজতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন এর কারন এই ইমালশানের মধ্যে ব্যবহৃত একটি হলুদ পদার্থ, যা অ্যান্টি-হ্যালেশান এজেন্ট হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অ্যালকোহল দিয়ে ধুয়ে ফেললে এর আর সবুজ সংবেদনশীলতা থাকে না। তিনি তারপর এই ইমালশানের সাথে নানা ধরনের অ্যানিলিন ডাই মিশ্রন ( যেমন, কোরালাইন, অ্যানিলিন গ্রীন)করেন এবং কিছু কিছু ডাই যে আলোক বর্ণালীর অন্যান্য রঙের প্রতি সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে দেয় (ডাই যে ওয়েভ লেন্থের আলো শোষন করে); ভোগেল এভাবে সবুজ, হলুদ, কমলা এবং এমনকি লাল রঙের সংবেদনশীলতা বাড়াতে পেরেছিলেন। ভোগেরে এই পদ্ধতি প্রথমে সাদা কালো ছবিতে ব্যবহার করা হলে পরে রঙ্গীন ফটোগ্রাফিরে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে রুপান্তরিত হয়েছিল।
উপরের ছবিটি আইসি নাইটস,বিখ্যাত মার্কিন ফটোগ্রাফার আলবার্ট স্টাইগলিতস (Albert Steiglitz) এর ১৮৯৩ সালের একটি ফটোগ্রাফ। তিনি ভোগেলের ছাত্র ছিলেন। ফটোগ্রাফির প্রতি তার ভালোবাসার সুত্রপাত ভোগেলের অনুপ্রেরণার ফসল।
সবার জন্য রঙ:
ফ্রেডেরিখ ইউজিন ইভস (১৮৫৬ -১৯৩৭) (সুত্র: http://web4brains.com/fourthquarter/ images/ives.jpg)
আমেরিকার কানেকটিকাটে জন্ম নেয়া ফ্রেডেরিখ ইউজিন ইভস ছিলেন রঙ্গীন এবং স্টেরিওস্কোপিক ফটোগ্রাফির একজন পাইওনিয়ার। ১৯ শতকের শেষ দিকে যখনও ফটোগ্রাফী ছিল দক্ষ এবং অবশ্যই ধনী কেমিষ্টদের সখ। কিন্ত ১৮৯৫ সালে ফ্রেডেরিখ ইউজিন ইভস উদ্ভাবন করেছিলেন অপেক্ষাকৃত কম খরচে ছবি তোলা এবং দেখার একটি কৌশল । এই ক্রোমস্কোপ পদ্ধতিতে ফিল্টারের মাধ্যমে তিনটি সাদা কালো নেগেটিভ তৈরী করা হতো, যেমনটি ম্যাক্সওয়েল করেছিলেন। কিন্তু ইভস একটি ছবি দেখার ভিউয়ারও তৈরী করেছিলেন, যা এই তিনটি ইমেজের আলো মিলিয়ে একটি ইমেজ তৈরী করে যা শুধু রঙ্গীন না, থ্রি ডিও বটে। প্রথম দিকে জনপ্রিয়তা পেলেও একটা ছবি তোলা জন্য তিনটা নেগেটিভ তৈরী করা খুব একটা ঝামেলামুক্ত ছিলো না, তাই এর প্রচলনও কমে যায়।
এই স্টেরিওস্কোপিক ছবিটা জানা মতে সান ফ্রান্সিসকোর সবচেয়ে পুরাতন রঙ্গীন ফটোগ্রাফ ,১৯০৬ সালের এপ্রিল মাসের ভুমিকম্পের পর তোলা ( অক্টোবর ৬,১৯০৬)।(Image: Smithsonian Institution)
ইভসের আরকটি যুগান্তকারী আবিষ্কার ছিল ১৮৮১ সালের হাফটোন ফটো এনগ্রেভিং প্রক্রিয়ার উন্নতি সাধন। মুল ফটোগ্রাফিক প্রিন্টকে ছাপার কাগজে কালি দিয়ে অনুরুপ ভাবে ছাপার উপযোগী করার কৌশল উদ্ভাবনে তার অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। আগে পত্রিকার পাতায় ছবি ছাপতে দ্ক্ষ হাতে কাঠে এনগ্রেভিং করতে হতো, যা সময়সাপেক্ষ একটা ব্যাপার ছিল আর ফলাফলও মুল ফটোগ্রাফের ধারে কাছে পৌছাতে পারত না। এখনো হাফটোনের মৌলিক কৌশল ব্যাবহার করেই কাগজে ফটোগ্রাফের ছবি অনুরুপ ছাপা হয়। গত ৫০ বছরে প্রধান প্রিন্টিং টেকনলজী, অফসেট লিথোগ্রাফিক প্রসেস এর অস্তিত্বই থাকতো না ইভসে অবদান ছাড়া। প্রতিদিনই যে অগনিত প্রকাশনা প্রকাশ হচ্ছে, খবরের কাগজ, বিজ্ঞাপন, ক্যালেন্ডার,প্যাকেজ ম্যাটেরিয়াল,যা কিছু প্রকাশনা আছে তা তৈরী হয়েছে যে যন্ত্রে, সেখানে সেই পুরোনো ইভসের হাফটোন পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে। সহজভাবে বলতে গেলে আইডিয়াটা হলো একধরনের দৃষ্টি বিভ্রম। ছবিটা আসলে অসংখ্য সমদুরবর্তী আলাদা আলাদে ডটে ভেঙ্গে ফেলা হয়, যা পরে নির্দিষ্ট দুরত্ব থেকে দেখলে মনে হবে পুর্নাঙ্গ শেড আর টোনের ছবি। সাদা কালো ফটোগ্রাফ ছাপানোর সময় ছবিটাকে ছবির নানা শেড আর টোন কিন্তু একবারেই ছাপা হয়, ছোট ছোট এই ডট গুলো একটার সাথে একটা মিশে একটা দৃষ্টি বিভ্রম তৈরী করে। মাইক্রোস্কোপের নীচে রাখলে বোঝা যায় আসলে সেই ডটগুলো। ছবির গুনগত মান নির্ভর করবে প্রতি ইন্চিতে কয়টি ডট আছে তার উপর। রঙ্গীন ফটোগ্রাফ ছাপানেরা সময় রঙগুলোকে ফিল্টার ব্যবহার করে আলাদা করা হয়, এবং একটি একটি রং ব্যবহার করে হায় টোন প্রসেসটাকে পুনরাবৃত্তি করে ছাপা হয় ( CYMK colour model), নীচের ছবিটি দেখুন।
উপরের ছবিটিকে ছাপার জন্য (CYMK হাফটোন সেপারেশন করা হয়েছে:C = Cyan, Y= Yellow, M= Magenta K=Key বা Black)
রঙ্গীন ফটোগ্রাফীর বিশ্বজয়:
আগুস্ত লুমিয়ের (বায়ে) এবং লুই লুমিয়ের (ডানে) (সুত্র : Wikimedia)
এর পরের গল্প দুই ফরাসী ভাইয়ের, যারা এক সাথে পরিচিত বিখ্যাত লুমিয়ের ব্রাদার্স নামে। আগুস্ত মারি লুই নিকোলাস লুমিয়ের (১৯ অক্টোবর ১৮৬২ – ১০ এপ্রিল ১৯৫৪) এবং লুই জ্যঁ লুমিয়ের (৫ অক্টোবর ১৮৬৪ – ৬ জুন, ১৯৪৮); তারা দুজনেই ছিলেন ইতিহাসে একেবারের প্রথম দিককার চলচ্চিত্র নির্মাতা (১৮৯৫), একদিন এই দুই ভাই ঘোষনা দিলেন, সিনেমার কোন ভবিষ্যত নেই। তাদের ক্যামেরাগুলো বেচে দিয়ে তারা মনোযোগ দিলেন ফটোগ্রাফির দিকে। সে কারনে চলচ্চিত্রের এই আদিপিতাদের চলচ্চিত্রে আর তেমন ভুমিকা রাখতে দেখা যায়নি। তবে সৌভাগ্য যে ফটোগ্রাফির উপর তাদের উৎসাহে ভাটা পড়েনি। কালার ফটোগ্রাফিকে সবার কাছে নিয়ে যাওয়া এবং এর ব্যপক বানিজ্যীকরন সম্ভব হয়েছে এই দুই ভাইয়ের কল্যানেই।
অটোক্রোম লুমিয়েরের বাক্স ( সুত্র: Wikipedia)
দুই ভাই্য়ের ভাষ্য অনুযায়ী, তাদের সেরা সৃষ্টি হলো অটোক্রোম, প্রথমবারের মত বানিজ্যিকভাবে বিক্রি করার মত রঙ্গীন ছবির প্লেট। অটোক্রোম খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। অটোক্রোম প্লেটে তোলা রঙ্গীন ছবি তার রঙ, তার সৌন্দর্য দিয়ে আজো বিশেষ আসনে আসীন শিল্পবোদ্ধাদেরর মনে। যা একসময় ভাবা অসম্ভব ছিল সেই কাজটি লুমিয়ের ভাইরা করে দেখালেন। ১৯০৩ সালে পেটেন্ট করা থাকলে ১৯০৭ সালে তারা বাজারে নিয়ে আসেন অটোক্রোম প্লেট। পরবর্তী ৩০ বছর তাদের কোম্পানী অগনিত অটোক্রোম প্লেট তৈরী করে যা ফটোগ্রাফীতে প্রথম বারের মত উজ্জ্বল রঙকে ধরতে সক্ষম হয়।
ফটোগ্রাফীর ইতিহাসে এই যুগান্তকারী আবিষ্কার অটোক্রোমটা আসলে কি? যদিও অটোক্রোম তৈরী করাটা কঠিন, কিন্ত অটোক্রোমের আইডিয়াটা আসলে খু্বই সাদামাটা, এমনকি বর্তমানের ডিজিটাল ক্যামেরাও একই কৌশল ব্যবহার করে শুধু সেই উপাদানগুলো ছাড়া। অটোক্রোম কিন্তু সেই ম্যাক্সওয়েলের অ্যাডিটিভ কালার সিনথেসিস মডেল ব্যবহার করছে একটি মোজাইক স্ক্রীন প্লেট প্রসেস এর মাধ্যমে। টেকনিক্যালী অটোক্রোমে কাচের প্লেটের উপরতিনটি রঙে রাঙানো আলুর স্টার্চের আনুবীক্ষনীক দানাগুলো মোজাইকের মত একটা পাতলা স্তরে সাজানো থাকে।স্টার্চের আনুবীক্ষনীক দানাগুলোকে ফিল্টার হিসাবে ব্যবহারের জন্য তিনটি রঙ ব্যবহার করা হয়,লালচে কমলা, সবুজ এবং নীলচে বেগুনী।স্টার্চের দানাগুলোর মধ্যে ফাকা জায়গাগুলো ভরা হয় ল্যাম্পব্ল্যাক দিয়ে(ল্যাম্প জালানোর মাধ্যমে এই কালো সুক্ষ কার্বন কনাগুলো সংগ্রহ করা হয়); এরপর প্লেটটাকে প্রচন্ড চাপের মধ্যে রাখা হয়,এই ফিল্টার লেয়ারটিকে কাচের প্লেটে সুষম বিন্যাসের জন্য।এরপর এর উপরে দেয়া হয় আলোক সংবেদী সিলভার ব্রোমাইডের ইমালশানের একটি স্তর। প্রত্যেকটা স্টার্চের কনা স্বতন্ত্র ফিল্টার হিসাবে কাজ করে, যা শুধুমাত্র একটি ওয়েভলেন্থের রঙ্গীন আলোকে যেতে দেয় ইমালশনে এক্সপোজড হয়, প্রসেস করার পর যেটা পাওয়া যায় সেটা হলো কাচের উপর এক্সপোজড ছবিটির একটি ট্রান্সপারেন্সি। আরো বেশ কয়েকধরনের রঙ্গীন ছবি তোলার কৌশল সে সময় আবিষ্কার হয়েছিল, কিন্ত অটোক্রোমের জনপ্রিয়তা ছিল প্রায় একচেটিয়া ১৯৩০ সাল অবধি। এরপর এই জায়গা দখল করে নেয় কোডাক্রোম আর তারপরে আগফাকালার।
আলুর আনুবীক্ষনীক স্টার্চের দানার ফিল্টার,তিনটি রঙের (লাল,সবুজ আর নীলচে বেগুনী), মাঝের ফাকা জায়গা ভরাট করেছে ল্যাম্পব্ল্যাক। ( সুত্র : http://www.autochromes. culture.fr/index.php?id=203&L=1 )
অটোক্রোম দেখার জন্য ডায়াস্কোপ (সুত্র: http://photographymuseum. org/diascope1.jpg)
সাদাকালো ছবির ফটোগ্রাফাররা রেখা আর টোনের বাইরে রঙ্গীন ছবির নতুন মাত্রার এক বিস্ময়কর জগতে প্রবেশ করলেন। অপুর্ব সব ফটোগ্রাফ আছে সেই সময়ের। কিন্ত প্লেটগুলো ভঙ্গুরতার জন্য অনেক অটোক্রোম নষ্ট হয়ে গেছে।
কিছু অটোক্রোম :
http://theimageworks.info/pub/autochrome/gallery/index.html থেকে..
১৯১২ সালে তোলা তাজমহল, হেলেন মার্ডক
১৯০৮ (Portrait of Elsie Toodles Thomas with a yellow flower wearing a kimono by Alvin Langdon Coburn)
১৯১০ (Indian dancer in traditional clothes accompanied by two musicians, India. Autochrome, circa 1910. ©Alinari Archives
১৯১০/Portrait of a young girl on a wicker couch. Autochrome, circa, 1910. ©Alinari Archives
১৯০৮ /Portrait of two young girls in a garden. Autochrome, 1908. Etheldreda Janet Laing.
১৯১০/George Bernard Shaw by Alvin Langdon Coburn (1882-1966).
১৯০৮/Mark Twain by Alvin Langdon Coburn. Autochrome, 1908.
১৯১৩/Portrait of Christina wearing a red cloak. Autochrome, 1913. Lieutenant Colonel Mervyn O’Gorman.
১৯১০/Still life of apples. Autochrome, circa 1910.United States. ©George Eastman House / Charles Zolle
আধুনিক ফিল্মের আবির্ভাব:
(১৯৪৯ সালে লন্ডন,শ্যাফ্টসবুরী এভিনিউ পিকাডিলী সার্কাস এর দিক থেকে তোলা, কোডাক্রোম, ছবি: শালমারস বাটারফিল্ড)(সুত্র: http://www.newscientist.com/data/ galleries/a-century-and-a-half-of-colour-photography/0048427b941.jpg
অটোক্রোমের বৈপ্লবিক অবদান সত্ত্বে কিছু কারীগরি সমস্যা ছিল,প্রথমত এর দীর্ঘ এক্সপোজার টাইম এবং এর চড়া দাম। কোডাক ১৯৩৫ সালে যখন এর সস্তা,আরো সেনসিটিভ ,সহজে ব্যবহার উপযোগী বিকল্প প্রতিযোগী বাজারে আনলো কোডাক্রোম নামে, এটি রাতারাতি সফলতা পেল। রঙ্গীন ছবি সবার ব্যবহারের উপযোগী করে দেবার জন্য যে মানুষটা সবচে বেশী অবদান রেখে গেছেন তিনি জর্জ ইষ্টম্যান। তার প্রতিষ্ঠানটির নামই কোডাক। একসময় রঙ্গীন ছবি আর কোডাক ছিল সমার্থক একটি শব্দ।
জর্জ ইষ্টম্যান (জুলাই ১২,১৮৫৪ – মার্চ ১৪,১৯৩২) (সুত্র:http://www.eastmanhouse .org/ media/ press_room/eastman.jpg)
ইষ্টম্যান হাইস্কুল শেষ করতে পারেননি, মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিধবা মা আর দুইবোনের দ্বায়িত্ব নিতে হয়। একটা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর অফিস বয় হিসাবে তার চাকরীজীবনের সুচনা।এরপর ব্যাঙ্কের ক্লার্ক। কারো পক্ষে ভাবা সম্ভব হয়নি তখন এই ছেলেটি সমস্ত প্রতিকুলতা কাটিয়ে একদিন জগতসেরা কোডাক কোম্পানীর কর্ণধার হবে।তার আবিষ্কার করা ক্যামেরা,ফিল্ম বদলে দেবে পৃথিবীটাকে।
১৮৭৭ সালে তিনি একবার ঠিক করেন সান্টো ডমিঙ্গো বেড়াতে যাবেন,এক বন্ধু বললো যাচ্ছো যখন ক্যামেরা নিও,ছবি তুলে আনতে পারবে। ইষ্টম্যানের কেন জানি প্রস্তাবটা মনে ধরলো, সেই যুগে ছবি তোলার মত প্রয়োজনীয় সরন্জামও কিনে ফেললেন। ক্যামেরা তখন আকারে মাইক্রোওয়েভের মত, তাছাড়া এর সাথে ভারী তেপায়া স্ট্যান্ডতো আছেই। এছাড়া ওয়েট প্লেট ফটোগ্রাফীর কেমিক্যালতো আছে। ইষ্টম্যানের সেবার সান্টো ডমিঙ্গো যাওয়া হলোনা ঠিকই, কিন্ত তাকে পেয়ে বসলো ফটোগ্রাফির নেশা।
১৮৭৮ সালের শুরুর দিকে ব্রিটিশ জার্নালে তিনি ড্রাই প্লেট ফটোপ্লেটের কথা প্রথম জানতে পারেন। ম্যাগাজিনে লেখা পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে,তিনি নিজে নিজে ড্রাই প্লেট বানানো শুরু করলেন। এবং সেই সাথে কিভাবে এটাকে আরো সবার জন্য ব্যবহার উপযোগী করা যায় সেটাই চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তার জীবনীকারের কাছে সহজ স্বীকারোক্তি করেছিলেন তিনি আসলে ব্যাক্তিগত সুবিধার জন্যই কাজটা শুরু করছিলেন, পরে বুঝতে পেরেছিলেন এর একটা হয়তোবা বানিজ্যিক সম্ভাবনা আছে।
এর পর তিনটি বছর দিনের বেলা ব্যাঙ্ক এর চাকরী আর রাতে মায়ের রান্নাঘরে ফটোগ্রাফীর ড্রাই প্লেট নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা। সম্বল শুধু ফটোগ্রাফী ম্যাগাজিনের কিছু লেখা আর আত্মবিশ্বাস ।প্রায় তিন বছর নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর, ইষ্টম্যান তার কাঙ্খিত ফরমুলা খুজে পেলেন।১৮৮০ সালে তার আবিষ্কৃত ড্রাই প্লেটের জন্য পেটেন্টও পান। শুধু রঙ্গীন ছবি ধারনের ড্রাই প্লেটই না,প্লেট বানানো মেশিনটাও তিনি ডিজাইন করেন। ১৮৮০ সালে এপ্রিলে ১২৫ ডলার দামের একটি সেকেন্ড হ্যান্ড ইনজিন কেনেন তার মেশিনটাকে চালানেরা জন্য এবং শুরু করেন তার নিজের কোম্পানী।তার উদ্দেশ্য ছিলো পেন্সিল ব্যবহার করার মত ক্যামেরাকেও সবার জন্য সহজে ব্যবহার উপযোগী আর সুলভ করে তোলা।
তার পরীক্ষার প্রথম লক্ষ্য ছিলো কিভাবে কাচের বদলে আরো ব্যবহার উপযোগী হালকা কোন কিছু খুজে বের করা। প্রথমে বেছে নিয়েছিলেন কাগজ,কাগজের উপর ফটোগ্রাফিক ইমালশান দিয়ে কাগজটাকে একটা রোলের সাহায্যে ব্যবহার করা। কিন্ত কাগজের সমস্যা হচ্ছে কাগজের গ্রেইনের ছবিও ফটোগ্রাফে চলে আসতো। সেটার জন্য ইষ্টম্যান যা করেছিলেন তা হলো প্রথমে কাগজের উপর সাধারন দ্রবীভুত জেলাটিনের একটা স্তর দিয়ে, এর উপর আলোক সংবেদী অদ্রাব্য জেলাটিনের আরেকটা স্তর দেন। এবং ছবি এক্সপোজার আর ডেভেলপের পর জেলাটিনের উপর ছবিটা কাগজ থেকে সরিয়ে স্বচ্ছ জেলাটিনের একটি প্লেটের উপর বসানো হতো, যা কলয়ডন নামের সেলুলোজ এর একটি দ্রবন দিয়ে ভার্নিশ করা হলেই শক্ত অথচ নমনীয় একটি ফিল্মে পরিণত হতো। তিনি ও তার গবেষনা সহযোগীরা ধীরে ধীরে এটাকে আরো নিখুত করে তোলেন, কাগজের বদলে তার রোল ফিল্মে ব্যবহার করা শুরু করেন প্লাস্টিক। এছাড়া তিনি একটা ছোট ডিভাইস তৈরী করেন যা তার রোল ফিল্মকে যেকোন ধরনের ক্যামেরায় ব্যবহার উপযোগী করে তোলে।
আদি কোডাক ক্যামেরা ( ছবি: http://posterous.com/getfile/ files.posterous.com/khaosmosis/2bbXdeyu85jSqvo9GCzBrzeKESdt1
RSB8Ib0GzjU0FujCgkxZPL6jLCo9Is2/.gif)
কোডাক রোল ফিল্ম (http://processc22.webs.com/Colneg.jpg)
কোডাক্রোম (http://www.blogcdn.com/www.engadget.com/ media/2010/12/kodachrome-copy.jpg)
তার কোম্পানী শুধু রোল ফিল্মই বানায়নি, একই সাথে আসে সহজেই ব্যবহারযোগ্য ক্যামেরা, যার নাম দিয়েছিলেন কোডাক। দামে কম সহজে ব্যবহার উপযোগী, ক্যামেরা অবশেষে সাধারন মানুষের হাতে পৌছে গেল। ১৮৮৮ সালে ক্যামেরার নামটা তার কোম্পানীর নামের সাথে যোগ করলেন : ইষ্টম্যান কোডাক।এরপর খুব দ্রুত যুক্তরাস্ট্রের অন্যতম সফল ব্যবসায়ীতে পরিনত হন জর্জ ইস্টম্যান। মনোপলীর অভিযোগও ওঠে, সরকারে বিরাগভাজন হন, তা স্বত্ত্বে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নানা ভাবে সাহায্য করেন ইষ্টম্যান, যেমন, গ্যাস মুখোশের জন্য ভঙ্গুর নয় এমন কাচ, প্লেন থেকে ছবি তোলার বিশেষ ক্যামেরা। ১৯১৩ সালেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার তার বিরুদ্ধে মোনোপলির অভিযোগ আনে। ১৯২১ সাল নাগাদ ইষ্টম্যান তার বেশ কিছু ব্যবসা ছেড়ে দেন কোর্টের বাইরে সমঝোতা করে।
কোডাক ফোল্ডিং ক্যামেরা ১৯১০ (http://cf.ltkcdn.net/antiques/images/std/95017-294×369-Antique1910kodackcamera.jpg)
জর্জ ইষ্টম্যান (বায়ে),টমাস এডিসনের সাথে ১৯২০ এর দশকের শেষের দিকে। এডিসন চলচ্চিত্র বানানো মুভি ক্যামেরা তৈরী করেন আর ইষ্টম্যানের কোডাক তৈরী করেন রোল ফিল্ম, তাদের দুজনের অবদানের ভিত্তিতে তৈরী হয় চলচ্চিত্র শিল্পের। (সুত্র : http://www.eastmanhouse. org/media/ press_room/east-ed.jpg)
চিরকুমার ইষ্টম্যান তার যদিও বেশীর ভাগই সময় দিয়েছেন তার কোম্পানীতে কিন্ত শেষের সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন, মাঝে মাঝে ৬ মাসের জন্য চলে যেতেন বেড়াতে। নানা জনহিতকর প্রকল্পে ইষ্টম্যান দান করে গেছেন তার সম্পত্তির বিশাল অংশ। তার এই দান করা শুরু হয়, সেই ১৮৮৬ সালে যখন তিনি কেবল একটু স্বচ্ছল হয়েছিলেন। পছন্দ ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো, দান করে গেছেন নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সবসময় বলতেন তিনি উচ্চ শিক্ষায় বিশ্বাস করেন না, কিন্তু শুধু রোচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয় তার কাছ থেকে দান হিসাবে পেয়েছেন প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার। তার টাকায় গড়ে উঠেছে রোচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীতের স্কুল,মেডিকেল স্কুল। এছাড়া এমআইটি কে দান করে যান ২০ মিলিয়ন ডলার ,তাও বেনামে, মিঃ স্মিথ নামে। আমেরিকার আফ্রিক্যান অ্যামেরিকান দের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থ সাহায্য দিয়ে গেছেন। অভাবী শিশুদের দাতে চিকিৎসা দেবার জন্য দাতব্য প্রতিস্ঠান তৈরী করে গেছেন নিজের শহর সহ অন্য অনেক শহরে। বেচে থাকতেই তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রেরে ৫ম সর্ব্বোচ্চ এককভাবে দানশীল ব্যাক্তি। নিজের কর্মচারীদের মধ্যেও দান করে গেছেন তার ১০ মিলিয়ণ ডলারের শেয়ার। ১৯৩০ সালে শরীর অসুখ বাসা বাধলে তার ব্যস্ত জীবন স্থবির হয়ে পড়ে। ১৯৩২ সালে শরীর বেশী ভেঙ্গে পড়লে তিনি তার পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ইষ্টম্যান কাটিয়ে গেছেন একটি পুর্ণাঙ্গ জীবন। অসম্ভব প্রতিকুলতাকে জয় করে কখনো ভুলে যাননি তার অতীত। তার দান স্পর্শ করেছে অজস্র মানুষের জীবন। তার আবিষ্কার আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে জীবনের স্মরনীয় মুহুর্তগুলোকে চিরকাল বন্দী করে রাখার।
শেষ ক্লিক …
১৫০ বছরের রঙ্গীন ফটোগ্রাফির ইতিহাসে অবদান আছে জানা অজানা অসংখ্য আবিষ্কারকের। তাদের কয়েকজনের কথাই এখানে স্মরন করলাম। সবার জন্য আমার শ্রদ্ধা।
এখন ডিজিট্যাল ক্যামেরার যুগ, লুমিয়ের ভাইদের স্টার্চ ফিল্টার এর জায়গায় দখল করেছে বহুদিন হলো নানা ধরনের ক্রমশঃ উন্নত লাইট ফিল্টার, যেমন বেয়ার ফিল্টার (ইষ্টম্যান কোডাক কোম্পানীর ব্রুস বেয়ারের আবিষ্কার) যারা ফিল্টার করে আলোর RGB (লাল,সবুজ আর নীল)রং এর রশ্মিকে আর সেলুলয়েড ফটো ফিল্মের জায়গায় এসেছে আরো সংবেদী ইমেজ সেন্সর বা charge-coupled device (CCD) বা Complementary metal–oxide–semiconductor (CMOS) ।
আপাতত এখানেই তাহলে শেষ করি প্রিয় সায়মন অ্যান্ড গারফাঙ্কেল এর Kodachrome গানটা দিয়ে ..
source: Internet