রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর জীবনী – Rabindranath Tagore

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  (৭ মে ১৮৬১ – ৭ আগস্ট ১৯৪১; ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ – ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে “গুরুদেব”, “কবিগুরু” ও “বিশ্বকবি” অভিধায় ভূষিত করা হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন: “কবিগুরু তোমার প্রতি চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই।” বাস্তবিকই, রবীন্দ্র-প্রতিভা এক পরম বিস্ময়। একাধারে তিনি কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, নাট্যপরিচালক, অভিনেতা, গীতিকার, চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা এবং আরও কত কিছু। তাঁর সৃজনশীলতার বহু বিচিত্র ধারা কেবল দেশবাসীকে নয়, বিশ্ববাসীর মনকেও প্লাবিত করেছে।

১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে (১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাতা সারদা দেবী। পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন সেকালের বিখ্যাত ধনী ব্যক্তি। তাঁর রাজকীয় জীবনযাপন দেখে ইংরেজরা তাঁকে ‘প্রিন্স’ আখ্যা দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পিতা-মাতার চতুর্দশ সন্তান। বালক রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন শুরু হয়। ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি তে। এতদিন পর্যন্ত এই মতটিই প্রচলিত ছিল। প্রচলিত এই ধারণার প্রতি সংশয় প্রকাশ করেছেন একালের প্রখ্যাত রবীন্দ্রজীবনীকার অধ্যাপক প্রশান্তকুমার পাল। তাঁর মতে ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি’ নয়, রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন যেখানে শুরু হয়, সেই প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমি’। সে যাই হোক, এর পরে তিনি নর্মাল স্কুল [ক্যালকাটা গবর্মেন্ট পাঠশালা?], বেঙ্গল একাডেমি, সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে পাঠ গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতিতে বালক রবীন্দ্রনাথের মন বসত না। সেজন্য বারংবার বিদ্যালয় পরিবর্তন করলেও বিদ্যালয়ের পাঠ তিনি শেষ করেননি। প্রথাবন্ধ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অসমাপ্ত থাকলেও বালক রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাচর্চায় কোনো ত্রুটি ঘটেনি। বাড়িতে যোগ্য গৃহশিক্ষকগণের তত্ত্বাবধানে তিনি বিভিন্ন বিষয়ের পাঠগ্রহণ করেছিলেন। গুণমানের বিচারে তাঁর গৃহশিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অপেক্ষা কোনো অংশে কম তো ছিলই না, বরং অনেক ব্যাপারে এগিয়ে ছিল। রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক পরিবেশও ছিল শিক্ষায় ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। কেবল লেখাপড়া নয়, সেকালের ঠাকুর পরিবারে সাহিত্য, শিল্প ও সংগীতচর্চার যে অনুকূল আবহাওয়া ছিল, রবীন্দ্রনাথ সেই আবহাওয়ার মধ্যেই ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছিলেন।

অল্প বয়সেই রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখতে শুরু করেন। তাঁর কবিতা রচনা কীভাবে শুরু হল, সে বিষয়ে জীবনস্মৃতি গ্রন্থে তিনি বলেছেন: “আমার বয়স তখন সাত-আট বছরের বেশি হইবে না। আমার এক ভাগিনেয় শ্রীযুক্ত জ্যোতিঃপ্রকাশ আমার চেয়ে বয়সে বেশ একটু বড়ো। তিনি তখন ইংরেজি সাহিত্যে প্রবেশ করিয়া খুব উৎসাহের সঙ্গে হ্যামলেটের স্বগত উক্তি আওড়াইতেছেন। আমার মতো শিশুকে কবিতা লেখাইবার জন্য তাঁহার হঠাৎ কেন যে উৎসাহ হইল তাহা আমি বলিতে পারি না। একদিন দুপুরবেলা তাঁহার ঘরে ডাকিয়া লইয়া বলিলেন, ‘তোমাকে পদ্য লিখিতে হইবে।’ বলিয়া পয়ারছন্দে চৌদ্দ অক্ষর যোগাযোগের রীতিপদ্ধতি আমাকে বুঝাইয়া দিলেন।” এর আগে বালক রবীন্দ্রনাথ কবিতা রচনা ব্যাপারটিকে একটি অসম্ভব কাণ্ড বলে মনে করতেন। কিন্তু জ্যোতিঃপ্রকাশের অনুপ্রেরণা এবং সহায়তায় তাঁর সেই ধারণার পরিবর্তন ঘটে। ‘জীবনস্মৃতি’-তে তিনি লিখেছেন: “গোটাকয়েক শব্দ নিজের হাতে জোড়াতাড়া দিতেই যখন তাহা পয়ার হইয়া উঠিল, তখন পদ্যরচনার মহিমা সম্বন্ধে মোহ আর টিকিল না।” শিশু রবীন্দ্রনাথের জীবনে এইভাবে যে কবিতাচর্চার সূচনা ঘটেছিল, তাতে কখনো আর বিরতি ঘটেনি। বয়স এবং অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবিতা রচনার পাশাপাশি প্রবন্ধ, গান, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অসাধারণ প্রতিভার আশ্চর্য বিকাশ ঘটতে থাকে।

১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে, রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন ১৭ বছর, তখন তিনি ইংল্যান্ডে যান। এটাই তাঁর প্রথম বিলাত যাত্রা। পরের বছর ভর্তি হন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সেখানে বেশিদিন থাকা সম্ভব হয়নি। পিতা দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’ তাঁর এই প্রথমবার বিলাত প্রবাসের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত।

১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে যশোরের বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণী দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ হয়। ভবতারিণী নামটি ঠাকুরবাড়িতে বেমানান। তাই ভবতারিণীর নতুন নামকরণ হয় মৃণালিনী। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ দারুণভাবে আহত হন। কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথকে যেমন স্নেহ করতেন, তেমনি তাকে সাহিত্যচর্চাতেও উৎসাহিত করতেন। রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু এই স্নেহময়ী রমণীর কথা মনে রেখেছিলেন। তাঁর বহু রচনায় কাদম্বরী দেবীর স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। ১৮৮৪-তেই পিতার নির্দেশে রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি দেখাশোনার ভার গ্রহণ করতে হয়। জমিদারি পরিদর্শনের সূত্রে তিনি বেশ কিছুকাল পদ্মাতীরবর্তী শিলাইদহ, সাজাদপুর প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাস করেন। এইসব অঞ্চলের উন্মুক্ত প্রকৃতি এবং সাধারণ মানুষের সান্নিধ্য তাঁর সৃষ্টিকর্মকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে।

১৯০১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ‘ব্রক্ষ্মচর্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মাত্র পাঁচজন ছাত্র নিয়ে শুরু হয় বিদ্যালয়ের কাজ। রবীন্দ্রনাথ এই বিদ্যালয়টিকে প্রাচীন ভারতের গুরুগৃহের আদর্শে তৈরি করতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই প্রতিষ্ঠানটি পরিণত হয় ‘বিশ্বভারতী’ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে দেশের মধ্যে যে রাজনৈতিক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, রবীন্দ্রনাথ তাতেও জড়িয়ে পড়েন। এই উপলক্ষ্যে রচনা করেন ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটি। রবীন্দ্রনাথ শুধু সাহিত্য-শিল্পের চর্চা করেননি, যখনই প্রয়োজন পড়েছে দেশ ও জাতির জন্য চিন্তা করেছেন, মানবতাবিরোধী যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি ‘স্যার’ উপাধি ত্যাগ করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথের স্বনামে প্রকাশিত প্রথম কবিতাটির নাম ‘হিন্দুমেলায় উপহার’। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে দ্বিভাষিক ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় এটি প্রকাশিত হয়েছিল। তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থের নাম ‘কবি-কাহিনী’। প্রকাশকাল ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দ। রবীন্দ্রনাথের প্রথম পর্বের রচনায় অন্যের রচনার প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে বিহারীলাল চক্রবর্তীর অনুসরণ অনেক ক্ষেত্রে বেশ স্পষ্ট। ১৮৮২-তে প্রকাশিত ‘সন্ধ্যাসংগীত’ নামের কাব্যটি থেকেই তিনি নিজস্ব রচনাশৈলীর সন্ধান পেয়েছিলেন। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রও এই কাব্যটির প্রশংসা করেছিলেন। বলা যায়, এই সময় থেকেই রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে তাঁর নিজের স্থানটি অধিকার করে নিয়েছিলেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল ‘মানসী’, ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’, ‘কল্পনা’, ‘ক্ষণিকা’, ‘নৈবেদ্য’, ‘থেয়া’, ‘গীতাঞ্জলি’, ‘গীতিমাল্য’, ‘গীতালি’, ‘বলাকা’, ‘মহুয়া’, ‘পুনশ্চ’, ‘পত্রপুট’, ‘আকাশ প্রদীপ’, ‘নবজাতক’, ‘জন্মদিনে’, ‘শেষ লেখা’ প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রথম নাটকটির নাম ‘রুদ্রচণ্ড’। প্রথম’ গীতিনাট্য ‘বাল্মীকি প্রতিভা’। ‘রাজা ও রাণী’, ‘বিসর্জন’, ‘শারদোৎসব’, ‘ডাকঘর’, ‘ফাল্গুনী’, ‘মুক্তধারা’, ‘রক্তকরবী’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক। বঙ্কিমচন্দ্রের পরে বাংলা উপন্যাস রবীন্দ্রনাথের হাতে নতুন ধারায় প্রবাহিত হয়। তাঁর ‘চোখের বালি’, ‘গোরা’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘যোগাযোগ’, ‘শেষের কবিতা’, ‘চার অধ্যায়’ প্রভৃতি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বাংলা ছোটগল্পের যথার্থ রূপটিও গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের হাতে। নব্বইটিরও বেশি ছোটগল্প রচনা করেছিলেন তিনি।

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকারদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের নাম সসম্মানে উচ্চারিত হয়ে থাকে। চিন্তাশীল প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ তুলনাহীন। ‘চারিত্রপূজা’, ‘সাহিত্য’, ‘সাহিত্যের পথে’, ‘স্বদেশ’, ‘সমাজ’, ‘শিক্ষা’, ‘মানুষের ধর্ম’, ‘কালান্তর’, ‘সভ্যতার সংকট’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থ। এছাড়া পত্রসাহিত্য ও ভ্রমণ সাহিত্যের মধ্য দিয়েও রবীন্দ্রপ্রতিভার আশ্চর্য দীপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর পত্র-সংকলন ‘ছিন্নপত্রাবলী’ তো গদ্যকাব্যের পর্যায়ে উন্নীত। ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’ (Song Offerings)-র জন্য ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এই পুরস্কার তাঁকে বিশ্বজনের কাছে পরিচিত করে তোলে।

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট (১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ) এই মহামানবের দেহাবসান ঘটে। কিন্তু এ শুধু তার মরদেহেরই অবসান। তার অমর সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে তিনি প্রতিনিয়ত আমাদের পাশে পাশে রয়েছেন। আমাদের চলার পথে তার রচনাবলি আজও অন্যতম অনুপ্রেরণা।

এটিও পড়ুন – কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি

গুরুত্বপূর্ণ তথ্যঃ

জন্ম:৭ মে ১৮৬১ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, কলকাতা, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)
মৃত্যু: ৭ আগস্ট ১৯৪১ (বয়স ৮০) জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, কলকাতা, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)
দাম্পত্যসঙ্গী: মৃণালিনী দেবী

পেশা: কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, গল্পকার
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি: গীতাঞ্জলি (১৯১০), রবীন্দ্র রচনাবলী, গোরা, আমার সোনার বাংলা, জন গণ মন, ঘরে বাইরে
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার (১৯১৩)

1 thought on “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর জীবনী – Rabindranath Tagore”

Comments are closed.