সুভাষচন্দ্র বসু এর জীবনী – Subhas Chandra Bose

সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক চিরস্মরণীয় কিংবদন্তি নেতা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি হলেন এক উজ্জ্বল ও মহান চরিত্র যিনি এই সংগ্রামে নিজের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

সুভাষচন্দ্র বসু এর জীবনী

ভারতের জাতীয় রাজনীতি তথা সমাজবোধে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা কোনও দিনই ম্লান হবে না। তিনি একটা গোটা জাতিকে ঝুঁকি নিয়ে লড়বার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। আর তাই তিনি সকলের ‘নেতাজি’। ‘নেতাজি‘ বলতে বাঙালি একজনকেই বোঝে তিনি সুভাষ চন্দ্র বসু। ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি এই ‘দেশনায়ক’ -এর জন্ম লগ্ন । আর সেই জন্মদিবস আজও সসম্মানে পালিত হয় এদেশের বিভিন্ন জায়গায়।

তাঁর বাবার নাম ছিলজানকীনাথ বসুু , তাঁর মায়ের নাম ছিল প্রভাবতী দেবী , তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল এমিলি শেঙ্কল এবং তাঁর সন্তানেের নাম ছিল অনিতা বসু পাফ ।

তিনি ১৯০৯ সালে রাভেনশো কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯১৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েন আর তারপর ১৯১৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন নিয়ে পড়েন ।

তিনি রাজনীতিবিদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ ফরওয়ার্ড ব্লক সংগঠন করেন । তিনি ছিলেন ভারতীয় নাগরিক তাঁর ধর্ম ছিল হিন্দু ধর্ম । তিনি উপাধি পেয়েছিলেন নেতাজী, দেশনায়ক ।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন সমগ্র বাংলা তথা বাঙালীর গর্ব, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু | ভারতের স্বাধীন হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান আমাদের কারোরই ভোলার নয় | তিনি দেশের জন্য যা করে গেছেন, তা হয়তো অনেক রাজনৈতিক নেতারাও করেননি জীবনে |

তিনি কিন্তু ছিলেন তাঁর বাবা মায়ের চোদ্দ সন্তানের মধ্যে নবমতম সন্তান | তাঁর মেজদা ছিলেন শরৎচন্দ্র বসু, যিনি তাঁকে খুব ভালোবাসতেন এবং ছোট্ট নেতাজীরও খুব কাছের মানুষ ছিলেন তিনি |

সুভাষচন্দ্র বসু

নেতাজীর মধ্যে এই দেশপ্রেম ব্যাপারটা জাগে তাঁর বাবার হাত ধরেই | যদিও তাঁর বাবা একজন ব্রিটিশ শাসিত সরকারী অফিসে কর্মরত ছিলেন, তবুও তিনি তৎকালীন কংগ্রেসের সমস্ত অধিবেশনে যোগদান করতেন এবং সাধারণ মানুষের খুব সেবা করতেন | তিনি স্বদেশী এবং জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পক্ষপাতী ।

ছোটবেলা থেকেই সুভাষচন্দ্র, পড়াশোনার বিষয়ে ভীষন মনোযোগী ছিলেন, আর তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কটকের এক প্রোটেস্ট্যান্ড ইউরোপীয় স্কুল থেকে | এরপর ১৯০৯ সালে তিনি সেখান থেকে ভর্তি হন কটকের রাভেনশো কলেজিয়েট স্কুলে |

স্কুলে পড়ার সময়, তিনি সেই স্কুলের প্রিন্সিপাল বেনিমধাব দাসের ব্যক্তিত্বের উপর বিশেষভাবে প্রভাবিত হন এবং তাঁরই সহযোগীতায় ছোট্ট সুভাষ, স্বামী বিবেকানন্দের বই পড়তে আগ্রহী হয়েও পরেন  । সুভাষচন্দ্র বোস অবশ্য পরবর্তীকালে তাঁর লেখায় এটা উল্লেখ করেছিলেন যে, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও লেখা বই তাঁকে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীতে পরিণত করেছিলো | স্বামীজির লেখা বই পড়েই তিনি তাঁর জীবনের আসল উদ্দেশ্য খুঁজে পান |

সাল ১৯১১, যখন নেতাজী ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কলকাতায় প্রথমস্থান অধিকার করেন । এরপর তিনি ১৯১১ সালে ভর্তি হন কোলকাতার প্রেসিডেন্সিতে, কিন্তু সেখানে শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে ভারত বিরোধী মত পার্থক্যর জন্য ভীষন সংঘাত শুরু হয় |

সেই সংঘাতে, যেহেতু সুভাষচন্দ্র ভারতীয় ছাত্রদের পক্ষে ছিলেন তাই তাঁকে এক বছরের জন্য কলেজ থেকে বহিস্কার করে দেওয়া হয় এবং পরীক্ষা দেওয়ারও অনুমতি দেওয়া হয়না |

তারপর ১৯১৮ সালে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে, দর্শনে সাম্মানিক সহ বি.এ পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি |

কোলকাতায় পড়াশোনা শেষ করে সুভাষচন্দ্র বসু, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত ফিজউইলিয়াম কলেজে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন । সেখানে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করে তিনি প্রায় নিয়োগপত্র পেয়ে যান, কিন্তু বিপ্লব সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি হওয়ার জন্য সেই নিয়োগও প্রত্যাখ্যান করেন |

১৩ই এপ্রিল ১৯১৯, যখন অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড ও দমনমূলক রাওলাট আইন সমস্ত ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে । এইরুপ বিশৃঙ্খলার পর, নেতাজী ‘স্বরাজ’ নামক একটি খবরের কাগজের হয়ে লেখালেখি শুরু করেন এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচারের দায়িত্বে নিযুক্ত হন ।

তারপর ১৯৩৮ সালে তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন আর ১৯৩৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য ত্রিপুরা অধিবেশনে কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন ।

সুভাষচন্দ্র বসু এই নির্বাচনে জয়লাভ করলেও গান্ধীজির বিরোধিতার ফলস্বরূপ তাকে বলা হয় পদত্যাগ পত্র পেশ করতে; নাহলে কার্যনির্বাহী কমিটির সব সদস্য পদত্যাগ করবে । এইসব নানা কারণে তিনি অবশেষে নিজেই কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেণ এবং “ফরওয়ার্ড ব্লক” নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন ।

কিন্তু সেইসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় আর সেই যুদ্ধে ভারতীয় সেনারা ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয় | ভারতবর্ষের এইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার ব্যাপারে সুভাষচন্দ্র বসু ভীষনভাবে ব্যথিত হন | তিনি সেই সময় গৃহবন্দি ছিলেন কিন্তু মনে মনে তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন দেশত্যাগ করার ।

অবশেষে তাঁর দলের একজন সদস্যকে নিয়ে তিনি, আফগানিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে জার্মানি পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন | সেখানে গিয়ে তিনি প্রথমে বার্লিনে “ভারতীয় মুক্ত কেন্দ্র” গড়ে তোলেন, আর তারপর ভারতের স্বাধীনতার জন্য তিনি জার্মান নেতা এডলফ হিটলারের সাহায্য চান |

সুভাষ চন্দ্র বসু আশা করেছিলেন, ব্রিটিশদের উপর তাঁর সৈন্যবাহিনীর হামলার খবর শুনে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে হতাশ হয়ে সেখানে যোগ দেবে কিন্তু তা একদমই হয়নি | কারণ খুব সংখ্যক ভারতীয় সেনা সেই হামলার পর তাঁর বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো |

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে যখন জাপান আত্মসমর্পণ করে আমেরিকার কাছে, তখন সেইসাথে তাঁর জাতীয় সেনাবাহিনীও আত্মসমর্পণ করে নেয় |

জাপানের এই ঘোরতর দূর্দশার পর নেতাজী, ১৮ই আগস্ট ১৯৪৫ সালে জাপানের তাইহুকু বিমানবন্দর থেকে প্লেনে করে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনার কবলে পরেন এবং সেইসাথে মারা যান | যদিও তাঁর এই মৃত্যুর সত্যতা সম্পর্কে আজও মানুষ অজানা | কেউ ঠিক ভাবে জানেন না যে, সেই দিনটির পর নেতাজীর কি হলো |

অনেক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ঘটনা একদম ভুয়ো | নেতাজীর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে উঁচুতলার কিছু ভারতীয় নেতারা এবং ইংরেজ সরকার মিলিতভাবে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করেন নৃশংস ভাবে ।

অনুমানে তার একটি মৃত্যুর ডেট অনুমান করা হয়েছে সেটা হল ১৮ই আগস্ট ১৯৪৫ (বিতর্কিত) ।

সত্যিই তিনি আমাদের দেশের একজন সত্তিকারের নায়ক ছিলেন তাকে আজ পর্যন্ত আমাদের দেশের মানুষ তাঁকে স্মরণ করে চলেছে এবং সারাজীবন স্মরণ করে চলবে ।

এটিও পড়ুন – সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এর জীবনী